দুই পুরুষ (উপন্যাস) পর্ব-৩
দুই পুরুষ
এম, আব্দুল্লাহ আল মামুন
(উপন্যাস) পর্ব- ৩
- সাহিত্যিকদের কথা ছেড়ে দাও, তারা বেচারা গরীব মানুষ, ওদের
দিয়ে আর আমাদের কি উপকার হবে। ওদের নিজেদেরই কে উপকার করে তার ঠিক নেই।
- তবু
যা-ই-হােক একটা উপন্যাস তাে লিখেছি। বইটার প্রশংসাও তাে কিছু হয়েছে,
বিক্রি যাই বা হল।
- সে তাে তুমি চাকরিতে ছিলে বলে লােকে তােমাকে প্রশংসা
করেছে। সেটাতাে তাদের মনের কথা নয়, ওটা তােমাকে খােসামােদ করার জন্য
করেছে।
-সে যাই হােক কচির বিয়ের কথা আমি ভাবছি না, নেচেও তাে ওর খুব নাম
হয়েছে। তারপর ল' পাশ করেছে।
- কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয় ?
- মিস্টার জাকির বিরক্ত হয়ে বললেন, ছিঃ ছিঃ লােকে বলবে কি ? আমার মেয়ের
বিয়ের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিব ! আর তাছাড়া আমাদের তাে একমাত্র মেয়ে, যে
বিয়ে করবে সে তাে আমার সব টাকা পাবে, সেটার কি কম দাম ? সেই লােভও তাে
অনেকের আছে।
একবার আজবাহার সাহেবের ছেলেকে দিয়ে বিয়ের কথা হয়েছিল কচির
সাথে সে কথা ভাবছেন মিস্টার জাকির ।
-মিস্টার জাকির বললেন, আজবাহার সাহেবের
ছেলে। ভালাে চাকরি করে।
- কি নাম তার ?
-রিটন। ওর বাবা মা যথেষ্ট ভালাে,
দু'জনই এক সংগে হজ্জ্ব করেছে।
- বাবা কি করে ?
- ব্যবসা করে। তা ছেলে যে চাকরি
করে কত টাকা বেতন পায় ?
- সঠিক বলতে পারবাে না তবে শুনেছি সিনিয়র অফিসার,
হবেই তাে ৩০ থেকে ৪০ হাজার। পরে আস্তে আস্তে আরাে বাড়বে।
মিসেস জাকিরের
বরাবর সাধ, ভাল পােস্টে চাকরি করে এবং ভাল ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া, নইলে
ইজ্জত থাকে না। লােকে যখন জিজ্ঞেস করবে আপনার জামাই কি করে ? তখন তাে ভালাে
একটা জবাব দিতেই হবে।
ছােট চাকরি করে, এ রকম পাত্রের সঙ্গে তাে বিয়ে
দেওয়াই যায় না, লােকে তাহলে বলবে কি ? সমাজে তাহলে ছিঃ ছিঃ পরে যাবে। তখন
আর লজ্জায় কাউকে
মুখ দেখানাে যাবে না । কিন্তু যদি শােনে পাত্র ফাস্ট ক্লাস চাকরি করে ।
তাহলে জাকির পরিবারের ইজ্জত বাড়বে বই কমবে না ।
- মিস্টার জাকির বলেছিলেন ,
আজবাহার সাহেবদের কে একদিন দাওয়াত করে খাইয়ে দেই ।
- মিসেস জাকির , তাই
কর । আমিও দেখি কচিও দেখুক ।
সব কিছুর ব্যবস্থা করা হলাে একদিন রাতে
ডিনারের খাবার দাওয়াত করা । হয়েছিল তাদের কে। গাড়িতে আসতে আসতে সেই সব
কথাই ভাবছিলেন । মিস্টার জাকির ও মিসেস জাকির ।
- মনে আছে রিটন নিজেই গাড়ী
চালিয়ে এলাে আমাদের বাড়িতে , ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাতটা ।
রিটন নিজের
চেষ্টায় ভাল একটা চাকরি পেয়েছে । কোন ততবির করতে হয় নি । বলা যায়
নিজের গুণেই ।
আজবাহার সাহেব এলেন রিটন এলেন , দারােয়ান স্ব সন্মানে
তাদেরকে । ড্রইং রুমে বসিয়ে দিল । মিসেস জাকির একটা শান্তিপুর তাঁতের
শাড়ি পরে মুখে পাউডার স্লো মেখে তৈরী হয়েই ছিলেন ।
- কচি বলল , আমি কোন
শাড়িটা পড়বাে ?
- কেন ? তুমি কালাে দামী শাড়িটা পরবে বলেই তাে আমি
শান্তিপুরির শাড়িটা পরেছি ।
তাতে আমার পাশে তােমাকে খুব সুন্দর দেখাবে ।
মনে রেখাে , যে আসছে সে । একজন যে - সে লােক নয় , একজন ভাল অফিসার ।
-
তুমি না বলেছিলে ওদের বাসা নাকি অনেক দূরে ?
- তাতে কি হয়েছে , তুমি তাে
আর শ্বশুর বাড়িতে ঘর করছ না ।
- কেন বিয়ে হলে শ্বশুর বাড়িতে থাকতে হবে
না ?
- সে কথা তােমাকে কে বলল ? রিটন কোয়াটার পাবে সেখানেই থাকবে তােমরা ।
- কিন্তু কোয়াটার যতদিন না পায় ততদিন ?
- বিয়ের কথা পাকা হলেই কোয়াটার
পেয়ে যাবে, সে ব্যবস্থা করে দিবে তােমার বাবা । তােমার বাবা একজন ডি সি
তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন ? তােমার বাবার মত যারা আছেন তারাই তাে দেশ চালাই
এটাতাে তুমি ভালাে করেই জানাে । মিনিস্টাররা কি সবাই লেখাপড়া জানে তােমার
বাবার মতাে ? তারা অনেকেই জেল খেটেছে অনেকেই অনেক কষ্ট করেছে । তারা আজ আছে
কাল ?নেই
কিন্তু তােমার বাবা রীতি মত লেখাপড়া করে ভাল রেজাল্ট করে তারপর পরীক্ষায়
চান্স পেয়ে আস্তে আস্তে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এতাে দূর এসেছে ।
মিয়েকেও
সাজিয়ে দিয়েছে মিসেস জাকির । কালাে দামী শাড়ির সাথে সােনালী রংয়ের দামি
ব্লাউজ । তারপর মুখে , কানে , ঘাড়ে সুন্দর ভাবে মেকআপ করে সাজিয়ে দিয়ে
ছিলেন ।
- বলেছিলেন তুমি বেশী কথা বলবে না , শুনে রেখাে বেশী টকেটিভ মেয়েদের
পছন্দ করে না বড় বড় অফিসাররা ।
সব রকম রিহার্সেল দেওয়া ছিল মেয়েকে ।
যেই আজবাহার সাহেবের আসার খবর দিয়ে গেল কাজের বুয়া , সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে
এসেছিলেন মিস্টার জাকির , পিছনে পিছনে মিসেস জাকির ।
- হ্যাল্লো রিটন কেমন
আছাে ? বাড়ি চিনতে কষ্ট হয় নি তাে ?
রিটন খুব লাজুক প্রকৃতির ছেলে । বেশী
কথা বলে না চিরকাল লেখাপড়া নিয়েই কাটিয়েছে । বলল , না আমার কোন কষ্ট
হয় নি ।
এই সময় কচি আস্তে আস্তে এসে দাঁড়াল । আগে থেকেই রিহার্সেল
দেওয়া ছিল । বলা ছিল যে কথা আরম্ভ হওয়ার একটু পরেই ঘরে ঢুকবে ।
- এই দেখ
আমার মেয়ে কচি - ল ’ ইয়ার । সালাম দাও কচি , তুমি এটা জানাে না ।
কচি
লজ্জায় সব ভুলে গেছে । সালাম দিল , রিটন সহ সবাই সালামের জবাব দিল । কালাে
শাড়ি পরে মুখে সুন্দর মেকআপ করে কচিকে লােভনীয় দেখাচ্ছিল ।
- মিস্টার
জাকির বললেন , নতুন চাকরি কেমন চলছে তােমার ?
- ভাল ।
গল্প চলল অনেক্ষণ ,
সেকালের সঙ্গে একালের তুলনা মূলক আলােচনা মিসেস জাকির মাঝখানে বাধা দিয়ে
বললেন , তােমরা শুধু গল্পই করবে ? গল্প করলেই পেট ভরে ! কাজের বুয়াকে
টেবিল সাজাতে বলল । আসলে কাজের বুয়া বললে ভুল হবে । অনেক পুরােনাে বুয়া
তাই তাঁদের ফ্যামেলির একজন হয়ে গেছে । কচি তাকে খালা বলে ডাকে । খালা
টেবিল সাজাল , অনেক রকম আয়ােজন করেছিলেন মিসেস জাকির , হবু জামাইকে ভাল
করে খাতির করতে হয়। ১৭
খাওয়া
শেষে বিদায় নিয়ে চলে গেল । এ বেপারে কথা হবে পরে । তারা সবাই চলে যাবার
পর মিসেস জাকির মেয়েকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন , কিরে রিটনকে তাের পছন্দ
হয়েছে বল ?
কচি চুপ করে রইল । মা আবার জিজ্ঞেস করলেন , জানিস রিটন যে সে
পাত্র । নয় অনেক বড় অফিসার !
- কচি মন খারাপ করে বলল , কিন্তু মা ও যে
বড় কালাে ।
- কালাে হয়েছে তাে কি হয়েছে তাের বাবাও তাে কালাে পুরুষ মানুষ
কালাে হলে ক্ষতি কি ? বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মানুষ কালাে ।
তবুও মেয়ের মন
ভিজল না ।
- মিস্টার জাকির বললেন , কি বলল কচি রিটনকে পছন্দ হয়েছে ?
- না ।
- কেন ?
- অফিসার হলেও কালাে ছেলেকে ও বিয়ে করবে না ।
- আমিও তাে কালাে ।
কালাে রং দিয়ে কি মানুষের বিচার হবে ? পােস্টটা দেখতে হবে না , কত লােক
সালাম দিবে , কত বড় গাড়ি পাবে , কত জায়গার সভাপতি হবে , প্রধান অতিথি
হবে , কত ফুলের মালা পাবে । যেমনটি আমি পাচ্ছি ।
মেয়েও তেমনি এক গুঁয়ে ,
কালােকে কিছুতেই বিয়ে করবে না । এমনি করে আরাে দশটা পাত্রকে বাড়িতে ডেকে
ডিনার করালেন । কত ডাক্তার , কত ইঞ্জিনিয়ার , কত বড় বড় ফ্যামেলির ছেলে ,
কত ভাল ভাল নতুন চাকরি পাওয়া । ছেলে । চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেন নি
মিস্টার জাকির ।
কেউ কালাে , কেউ রােগা , কেউ বেটে , আবার কেউ বা গরীব ।
কাউকেই পছন্দ হল না কচির । মেয়ে বড় হয়েছে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাে কিছু
করা হয় । অশিক্ষিতা গ্রামের মেয়ে হলে তাকে যার তার গলায় ঝুলিয়ে দিলে
চলে , কিন্তু এ তাে তা নয় ।
এমনি করে চলতে চলতেই মিস্টার জাকির রিটায়ার
করে গেলেন সেই রিটায়ারমেন্ট কে উপলক্ষ করেই আজ এই ফেয়ার ওয়েল হল ।
রাত ৯
টা বাজল , ১০ টা বাজল , শেষ কালে রাত ১১ টার দিকে মিস্টার জাকির ও মিসেস
জাকির খেয়ে নিলেন । তাঁরা না খেলে আবার চাকর বাকর কেউই খেতে পাবে না । শেষ
কালে খেয়ে দেয়ে উঠে তিনি থানায় গেলেন । ১৮
সেখানে
ও সি খুব খাতির করে বসালেন । ডায়েরি লেখা হল মেয়ের ঘটনা দিয়ে ।
- ও সি
বললেন , কিন্তু স্যার পেছনে কোন কারাে সাথে ভালবাসা ছিল নাতাে ?
- না না
মেয়ে আমার সে রকম নয় । সে গাড়িতে করে কলেজে যেতাে আর গাড়িতে করে বাড়ি
ফিরে আসততা , কারাে সংগে মিশবার সুযােগই তার ছিল না ।
- অন্য সময় কি করত ?
- অন্য সময় বই পড়তাে আর না হয় আমাদের সংগে মার্কেটিং বা পার্টিতে যেতাে
।
- চিঠি পত্র ?
- না না এখন চিঠি পত্রের সময় আছে নাকি ।
- মােবাইল বা
টেলিফোন ।
- সে তাে মােবাইল ব্যবহার করে না । আমি দিতে চেয়েছি বরং সেই বলে ,
না । বাবা মােবাইল আমার তেমন দরকার নেই , আমি সারাদিন তাে বাড়িতেই থাকি ।
বেশী প্রয়ােজন হলে তােমারটাতাে আছেই । আর টেলিফোন আমার ঘরে থাকে । কোন
দিন ওকে ফোন রিসিভ করতেই দেখি নি । তাছাড়াও আমার মেয়ে সে রকম নয় ।
- ঠিক
আছে স্যার আমি ইনকোয়ারি করবাে এ ব্যাপারে ।
- দেখবেন যেন বেশী জানাজানি
না হয়ে যায় , জিনিসটা বেশী ছড়াক এ আমি চাই না ।
ও সি অভয় দিল । বললেন ,
না না সে আমাকে বলতে হবে না , আমি জিনিসটা খুব সিক্রেট রাখবাে , একটা কাজ
করবেন পাসপাের্ট সাইজের একটা । ফটোগ্রাফ আমাকে দিয়ে যাবেন । আর যদি বলেন
তাহলে আমিই কাল আপনার বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে পারি ।
বড় অফিসার হওয়ার অনেক
সুবিধা , বাস্তব জীবনে অনেকটা কাজে লাগে । পুলিশও তাঁদের সন্মান জানায় ।
অথচ সাধারণ লােকেরা তাদের কাছে যাক তারা তেমন খাতির করবে না । মিস্টার
জাকির জানতেন এ সব কথা । তাই সমস্ত ব্যাপারেই তার সুযােগ নিতেন । সাহিত্য
সম্মেলনের বেপারে তাঁর যে নাম এই জন্যই । তিনি যে একজন লেখক তার পেছনে ঐ
একই কারণ । তিনি জানতেন যতক্ষণ তিনি তাঁর চেয়ারে থাকবেন ততক্ষণ বিশ্বস্ত
লােক তাঁর কৃপা.........
চলবে-------------
কোন মন্তব্য নেই