Header Ads

দুই পুরুষ (উপন্যাস) পর্ব-২

দুই পুরুষ
                                         এম, আব্দুল্লাহ আল মামুন
(উপন্যাস) পর্ব- ২
           একটি মাত্র মেয়ে কচি। আর টাকার কথা যদি বলি তাে সেটা কোন সমস্যাই ছিল না মিস্টার জাকিরের কাছে। ডি সিরা যারা এতাে খাতির পেতাে সব যায়গায়, আর এতাে বাম ইনকাম হতাে বলতে গেলে তাদের মাইনের টাকাতে হাতই পরতাে না। 
          ধর কোন যায়গায় বেড়াতে গেলে, ডি সিরাতাে আর আলতু ফালতু যায়গায় বেড়াতে যায় না গেলে সেই রকম যায়গাতেই যায়। সেখানে গেলেতাে গেস্ট হাউস ছিল, সেখানে তাদের জন্য গাড়ি থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া সৰ কিছু আদর যত্নের উপর দিয়ে, টাকার প্রশ্নতাে আসেই না । 
          
           ডি সি সাহেব যখন রিটায়ার করলেন তখন তার অবস্থা প্রায় শােচনীয় কেউ তাদের আর আগের মত সালাম দিতাে না। পাস দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলেও কেউ চিনতে পারতাে না। 
          তখন আর উপাই না পেয়ে বড় বড় ক্লাবে গিয়ে ভর্তি হতে হতাে। শুধু বড় বড় মেম্বারদের কাছে নিজের অতীত জীবনের ঐশ্বর্যের গল্প করা ছাড়া আর কোন কাজই থাকতাে না। 
          সত্যিই তাদের অবস্থা হল বড় প্যাথেটিক। দেদার টাকা ব্যাংকে রেখেও কোন সুখ নেই। সেই টাকাতাে কেউ দেখতে পারছে না। চাকরি করার সময় উপন্যাস যে লিখেছেন সে উপন্যাসের ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশংসা বেড়িয়েছে কাগজে, রিটায়ার করার পর আর কেউ তাদের পরােয়া করে না। আগে বাড়িতে সকাল থেকে অতিথি। অভ্যাগতদের ভিড় লেগে থাকতাে, অফিসেও দর্শন প্রার্থীর সংখ্যা ছিল অঢেল । একটু হাসি মুখে অভ্যর্থনা করলেই তারা খুশিতে গলে যেতাে। কিন্তু সব জিনিসেরই একটা শেষ আছে, চিরকাল তাে কারাের চাকরি থাকে না। তাই মিস্টার জাকিরের দশা তাই হলাে । 
          একমাত্র সন্তান মিস্টার জাকিরের। যখন চাকরি ছিল তখন সেই সন্তানেরও কত খ্যাতি কত সুখ্যাতি। কচি বলতে সব কৃপাপ্রর্থীরা অজ্ঞান। তখন কচির নাচের ছবি উঠত কাগজে, ঢাকা, রাজশাহী, চিটাগাং, খুলনা সব জায়গায় যত পত্র পত্রিকা সব কাগজেই কচির নাচের ভঙ্গির ছবি ছাপা হতাে। বড় সাংবাদিক দিয়ে কচির নাচের ছবি তুলিয়ে নিত। আর চিঠি লিখে দিত এ ছবি ছাপাতে হবে। নইলে মিস্টার জাকির আগেকার মতন আর ভেতরের খবর দিবেন না। বিভিন্ন ভালাে ভালাে খবর মিস্টার জাকির দেন পত্রিকা ওয়ালাদের। যেমন লাভ, মিস্টার জাকিরেরও তেমন লাভ। মিস্টার জাকিরকে খুশি করতে গেলে তার মেয়েকে আগে খুশি করতে হবে। এটাই ছিল সকলের পলিসি। কিন্তু মিস্টার জাকির মনে করতেন তাঁর মেয়ে বুঝি সত্যিই ভালাে নাচে। খবরের কাগজ ওয়ালারা জিজ্ঞেস করত আপনার মেয়ে একটা প্রতিভা, এতাে ভালাে নাচ শিখল কোথা থেকে ? 
         মিস্টার জাকির বলতেন, গুরু দিপংকর বাবুর কাছ থেকে ?
        দিপংকর! নামটা শুনে সবাই শ্রদ্ধায়- ভক্তিতে গদ গদ হয়ে উঠত। মিস্টার জাকির বলতেন আর কথক নিত্য শিখিয়েছি ইন্ডিয়াতে বালা সরস্বতীর কাছ থেকে- 
        শ্রোতারা বলতাে তাই বলুন! অনেক টাকা আপনি খরচ করেছেন মেয়ের জন্য। 
        মিসেস জাকির বলতেন কচির বয়সতাে মাত্র চৌদ্দ বছর, এরই মধ্যে শুধু নাচের জন্য ২ লাখ টাকা খরচ করেছি। 
        আর লেখাপড়াতেতাে আপনার মেয়ে খুব ভালাে। 
       মিসেস জাকির বলতেন, প্রত্যেক বছরই তাে ফাস্ট হয় কচি । 
      সবাই বলে সত্যিই মিসেস জাকির রত্নগর্ভা । মেয়ে তাে অনেকেরই আছে কিন্তু এমন প্রতিভা সম্পন্ন মেয়ে ক'জনার আছে ? আরতাে অনেক ডি সি আছে, কই তাদের মেয়েরাওতাে ভালাে ভালাে স্কুলে পড়ে কলেজে উঠে, তারপরও তাদের বিয়ে দিতেই নাকাল হয়ে যায় বাপ মায়েরা। ভাগ্য বটে মিস্টার আর মিসেস জাকিরের, সুন্দর মায়ের সুন্দরী মেয়ে, আল্লাহ যাকে দেন তাকে এমনি করেই দেন। লক্ষী- সরস্বতীর এমন মিলন বড় একটা দেখা যায় না। সবই মিস্টার জাকিরের ভাগ্য। 
          তার উপর আবার মিস্টার জাকির ডি সি হয়েও মস্ত বড় সাহিত্যিক, তাঁর ‘কঠিন মানুষ' উপন্যাসের কত সুনাম কাগজে বেরিয়েছে, সকলেই বইয়ের প্রশংসায় মুখর। 
          এবার নতুন কি উপন্যাস লিখছেন ? 
         মিস্টার জাকির বলতাে উপন্যাস লিখবার সময় কোথায় পাচ্ছি আজ কালতাে কাজে খুব ব্যস্ত, তবুও যখনই একটু সময় পাই এক পাতা দু’পাতা লিখে ফেলি। 
          কখন লেখেন রাত জেগে জেগে ? 
          হ্যাঁ রাত জেগে জেগে।

12
          সবাই ধন্য ধন্য করত । বলত আর কেন চাকরি করছেন । চাকরি ছেড়ে দিন । । আপনি যদি হােল টাইম লেখক হতেন তাহলে এর থেকে আরাে বেশী টাকা । উপার্জন করতেন । 
          মিস্টার জাকির বলতেন , আমিতাে চাকরি ছাড়তেই চাই । কিন্তু উপর থেকে চায় না যে আমি চাকরি ছাড়ি । উপর থেকে বলে তােমার মত ভালো লােক দরকার, এখন ভালাে লােক পাওয়াই মুসকিল । তাই আমাকে ছাড়তেই চায় না । 
        লােকে মন দিয়ে মিস্টার জাকিরের কথা শুনতাে , বলতাে তা তাে তা ... তাে । বটেই । তার পরেই হল কাণ্ড , মিস্টার জাকির রিটায়ার করলেন । তখনই বিপদ ঘনিয়ে । এলাে মিস্টার আর মিসেস জাকিরের জীবনে , কচি ল- পাস করেছে এক দিন সে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল । 
        অবাক কাণ্ড ! 
       সে দিন রিটায়ারমেন্টের দিন । তাঁকে অফিসের স্টাফরা ফেয়ার ওয়েল দিচ্ছে , মিস্টার আর মিসেস জাকির দু’জনই সেখানে গেছেন । প্রায় পঞ্চাশটা ফুলের মালা তার গলায় । একটা ব্রোঞ্জের ফ্রেমে মান পত্র তার হাতে তুলে দেওয়া হল ।  
          তিনি বিদায় ভাষণ দিলেন । ভাষণে বললেন , আমি এদেশে চাকরি করে সারা জীবন দেশ সেবা করেছি , চাকরিকে কখনাে আমি চাকরি মনে করি নি , আমি বরাবর ভেবেছি আমি দেশ সেবা করছি । দেশের কল্যাণের জন্য আমি প্রাণ দিয়ে কাজ করেছি , আজ আপনারা আমাকে যে সম্মান দিলেন তা আমার প্রাপ্য নয় , আপনাদের এ সম্মান আমি সেই দেশ মাতৃকার কাছেই পাঠিয়ে দিচ্ছি সেই সম্মানের প্রকৃত অধিকারী । 
          যথারীতি চটাপট করে হাত তালি পড়ল । তিনি সকলের কাছে সবিনয়ে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন । বাড়ি মানে কোয়াটার , এই কোয়াটার ছেড়ে তিনি রাজশাহীতে নতুন করা তাঁর বাড়িতে চলে যাবেন । ভবিষ্যতে সেখানেই । বসে বসে শেষ জীবনটা তিনি সাহিত্য করে কাটাবেন । সমস্ত প্ল্যান হয়ে আছে । 
        কিন্তু বাড়ি এসেই ডাকলেন , কচি - কচি 
        কোন সাড়া শব্দ পেলেন না , মিসেস জাকিরও ডাকলেন কোথায় রে মা ? 
       চাকর বাকররা সবাই দৌড়ে এলাে । কচি কোথায় ? 
       সবাই ভয়ে অস্থির । সাহেব , মেম সাহেব সকলের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন । কোথায় গেলাে কচি ? 
       মিসেস জাকির জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে কেউ এসেছিল ?
১৩
      আয়া বলল , না মেম সাহেব কেউতাে আসে নি 

      তাহলে কি উড়ে গেলাে সে ? 

       কারাে মুখেই কোন জবাব নেই । কেউ জানে না কচি গেল কোথায় । 

       একজন বেয়ারা বলল , আমি তাে দেখেছিলাম কচি পড়ছেন । 

        নাহ শেষ পর্যন্ত কচিকে পাওয়া গেল না , অনেক যায়গায় টেলিফোন করলেন । মিস্টার জাকির । মিস্টার জাকিরের বন্ধু বান্ধবের বাড়িতেও খোঁজ করলেন । কারাে বাড়িতেই যায় নি তবে গেল কোথায় ? 

        মিসেস জাকির তাঁর নিজের বন্ধু বান্ধবের বাড়িতেও টেলিফোন করতে লাগলেন । তারাও বললেন কচি তাদের বাড়িতে যায় নি ।। 

        শেষ কালে টেলিফোন করা বন্ধ করলেন । মিছেমিছি মেয়ে পালানাের খবরটা বেশী জানাজানি না হওয়াই ভালাে । সেদিন তার ফেয়ার ওয়েল সভা হয়ে । গেছে । সমস্ত আনন্দ তাঁর ধুলিস্বাদ হয়ে গেল এক মুহুর্তে । আর সঙ্গে সঙ্গে একটা অন্য ভাবনাও ছিল । ভাবনাটা প্রত্যেক রিটায়ার্ড লােকেরই হয় আর আগেকার মতাে তিনি সালাম পাবেন না । খাতির পাবেন না । কোথাও গেলে কেউ আর তাকে তেমন করে মাথা নিচু করে সম্মান করবে না । আরাে কতজন । তাঁর আগে রিটায়ার করে গেল । কত লােক তাদের ভয় করত ভক্তি করত । আর ঠিক রিটায়ার করার দিন থেকে অন্য রকম । জামা - কাপড় , কোর্ট - প্যান্ট আগেকার মতই আছে । কিন্তু কোথায় যেন কিছু মিল নেই । স্টাফ সেই একই । আছে অথচ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সব বদলে গেছে । হঠাৎ সামনে মুখােমুখি হলে । কেউ অবশ্য অপমান করে না । কিন্তু সে রকম ভক্তিতে গদগদ আর আগেকার মত নেই । 

         ফেয়ার ওয়েল থেকে ফেরবার পথে সারা রাস্তাটা তিনি কেবল এই সব কথাই ভাবছিলেন । তাঁরও সেই একই দশা হবে । পরে তাঁকে আর কেউ ভক্তি করবে না । তখন তাঁকেই ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে হবে কি গাে রেজা কেমন । আছে সব ? সেই রেজা কত দিন খােসামদ করেছে তার জামাইয়ের একটা চাকরির জন্যে । চাকরি একটা তার জামাই এর করেও দিয়েছিলেন । তার জন্য মিস্টার জাকিরের উপর তার চির জীবন কৃতজ্ঞ থাকাই উচিৎ । কিন্তু তা নয় । তার জায়গায় যে এসে বসবে তখন তাকেই আবার খাতির করবে তারা । এই ই - জগৎ , এই - ই নিয়ম পৃথিবীর । একজন আসে আর একজন চলে গেলে তখন আবার একজন এসে তার জায়গাটা নিয়ে নেয়।
14
        আর এতাে চাকরি । চাকরিটাই তাে সব নয় । এরপরে আছে জীবন । জীবনেরও এই নিয়ম । এই পৃথিবী থেকেও এমনি করে একদিন চলে যেতে হবে । মিনিস্টার চলে যাবে , সেক্রেটারি চলে যাবে , হেড ক্লার্ক চলে যাবে । আজকের যারা যায় তারাও একদিন চলে যাবে । থাকবে শুধু বাড়িটা । এই বাড়িটা কি চিরকাল থাকবে ? তাও থাকবে না । 

       তিনিও একদিন থাকবেন না । তারপর যদি কিছু থাকে তাে তার উপন্যাস ‘ কঠিন মানুষটা হয়তাে থাকলেও থাকতে পারে । কারণ বিক্রি কিছু না হােক প্রশংসা করেছে সব পত্রিকাই । 

        কিম্বা এও হতে পারে , প্রশংসা যেটা করেছে লােকে , সেটা তার চাকরির জন্য । আজ তাঁর চাকরি গেল , সঙ্গে সঙ্গে হয়তাে তার বইটার কথাও লােকে ভুলে যাবে। 

        গাড়িতে যখন আসছিলেন তখন এই সব কথাই মনে পরছিল কেবল । 

       মিসেস জাকির বসেছিলেন পাশে । তিনি কি ভাবছিলেন কে জানে ? স্বামীর জন্য তারও একটা খাতির ছিল সমাজে । সব পার্টিতে স্বামীর সঙ্গে দাওয়াত হত । তাঁর ঐশ্বর্য দেখাবার একটা সুযােগ মিলতাে । এরপরে যখন রাজশাহী । যাবেন তখন হয়তাে আর পার্টিতে এমন নেমন্তন্ন হবে না । 

        কিন্তু যে দিন চাকরিতে ঢুকেছিলেন সে দিনই তাে জানতেন যে এ চেয়ার চিরকাল থাকবে না । একদিন তাঁকে চেয়ার থেকে বিদায় নিতে হবে । সুতরাং দু’জনেই এই অবস্থার জন্য তৈরী ছিলেন মনে মনে । কিন্তু সে দিনটা যে এতাে তাড়াতাড়ি আসবে তা কল্পনা করতে পারেন নি । হঠাৎ মিসেস জাকির বললেন কচির বিয়ে তাে দিতে হবে এবারে । 

        মিস্টার অন্য মনস্ক ছিলেন । ফেয়ার ওয়েলে কে কি বক্তৃতা দিয়েছেন সেই সবই ভাবছিলেন । হঠাৎ স্ত্রীর প্রশ্ন শুনে বললেন , তাতাে দিতেই হবে- 

        স্ত্রী বললেন- তােমার চাকরিতে থাকতে থাকতেই দিয়ে দিলে ভালাে হতাে , এখন কি আর কেউ আমাদের কথা শুনবে ?

        - কেন শুনবে না ? আর আমরাতাে এখানে থাকছি না রাজশাহীতে কে কাকে চিনে ? ডি সির খাতির ওখানে নাই বা পেলাম , কিন্তু সাহিত্যিক মহল তাে আমায় খাতির করবে । কত জায়গায় সাহিত্যিকদের সভাপতিত্ব করার চান্স দিয়েছি । 

চলবে-------------

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.