দুই পুরুষ (উপন্যাস) পর্ব-৪
দুই পুরুষ
এম, আব্দুল্লাহ আল মামুন
উপন্যাস) পর্ব- ৪
পাবার জন্য উৎসুক থাকবে । তিনি এতদিন সেই সুযােগ সুবিধেই পেয়ে এসেছেন ।
কিন্তু এবার থেকে তা আর হবে না । এবার তাঁর চেয়ার গেল । ফেয়ার ওয়েল
পার্টিতে তিনি যতই ফুলের মালা পান না কেন এ ফুল কাঁটা ছাড়া আর কিছু নয় ।
এরপর থেকে তাঁকে আর অফিসে যেতে হবে না । তাঁর অভাবে । অফিসও অচল হবে না ।
অফিস যেমন চলছে তেমনি চলবে । তাঁর চেয়ারে এখন । থেকে নতুন যে বসবে ,
তাঁকেই সবাই সালাম করবে । জীবনের নিয়ম এই , একজন যায় আর একজন আসে । কারাে
অভাবে সংসারে কিছু অচল হয় না । ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ চলে গেছে ,
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নায়ক চার্চিল চলে গেছে , জার্মানির হিটলার চলে গেছে ,
মহাত্বা গান্ধী চলে গেছে তবুও কারাের কিছু অসুবিধা হয় নি । তাঁদের
যায়গায় আবার অন্য লােক এসে তাঁদের চেয়ারেই বসেছে । তবু পৃথিবী চলছে ।
আগেও যেমন চলেছে এখনও তেমনই চলছে এর পরেও তেমনি চলবে ।
এসব চিন্তা তিনি
রিটায়ার করবার আগ থেকেই করছিলেন এখন আবার নতুন করে চিন্তা করে কোন লাভ নেই
। ভেবে ছিলেন ব্যাংকে যা টাকা আছে । তাতে তাঁর জীবনটা চলে যাবে আর যদি
তিনি সে টাকাটা বাড়াতে চান তাে । ইনভেস্ট করবেন । সব চেয়ে ভাল
ইনভেষ্টমেন্ট হচ্ছে শেয়ার মার্কেট । বাজারে যখন শেয়ারের দাম কমবে তখন
কিনবেন আর যখন দাম বাড়বে তখন বেঁচবেন । বুড়াে বয়েসেও মােটা টাকা জমাতে
পারবেন । তাঁরতাে ঐ একটাই মেয়ে , মেয়েটার একটা ভালাে পাত্র দেখে বিয়ে
দিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত ।
মেয়েটাকে তিনি লেখাপড়া শিখিয়েছেন , মেয়েও
বুদ্ধিমতি । দেখতেও বেশ সুন্দর । সে দিক থেকে তাঁর কোন দুশ্চিন্তা ছিল না ।
কিন্তু আশ্চার্য , যে দিক থেকে দুশ্চিন্তা আসবার কথা নয় সেই দিক থেকেই
চরম দুশ্চিন্তা এলাে । এ এক আশ্চার্য ঘটনা ।
পুলিশে খবর দেওয়ার পর অনেক
দিন কেটে গেল , তবুও কোন খবর পেলেন না । মিসেস জাকির সেই দিন থেকে যে সেই
শয্যা নিয়েছেন আর উঠেন নি ।
- মিস্টার জাকির সান্তনা দিয়ে বললেন , ও
রকম ভেঙ্গে পরলে কি চলে ? সংসারে দুঃখ , শােক , যন্ত্রণা আসবেই ।
-
ভেঙ্গে পরবাে না । তুমি বলছাে কি ? খাইয়ে পড়িয়ে এতদিন তাকে মানুষ করলাম
আর সে কি না আজ এই রকম কাজ করল , আমি সােসাইটিতে মুখ দেখাব কী করে ?
-
সোসাইটির কার সঙ্গেই বা দেখা হচ্ছে , আমরা তাে আর এখানে থাকছি না।
-
কিন্তু রাজশাহীতেই বা মুখ দেখাবে কি করে ? সেখানেও তাে আত্মীয় স্বজন আছে ।
তারাতাে খবরটা শুনলেই আল্লাদে আটখানা হয়ে নাচবে ।।
- মিস্টার জাকির
সান্তনা দিলেন বললেন , তাদের সঙ্গে না মিসলেই হয় । কোন দিন আত্মীয়
স্বজনদের আমল দিই নি , এবার থেকেও তাদের আমল দিব । না । চুকে গেল লেটা ।
- মিসেস জাকির বললেন , তা না হয় মানলাম কিন্তু খবরটা শােনার পর তারাতাে নিজে
থেকেই আমাদের বাড়ি আসবে তখন ? তারা যদি জিজ্ঞেস করে । কচি কোথায় ?
-
বলবাে কচির বিয়ে হয়ে গেছে ।
- যদি জিজ্ঞেস করে কোথায় বিয়ে হয়ে গেছে ?
-
বলবাে লন্ডনে বিয়ে হয়ে গেছে । লন্ডনে তাে আর কেউ দেখতে যাচ্ছে না ।
-
খারাপ খবর আবার আগুনের মত ছড়ায় । তুমি যখন ডি সি হয়েছিলে তখন তাে
আত্মীয় স্বজনের মুখ গম্ভীর হয়ে ছিল । কিন্তু আমাদের কোন খারাপ খবর শুনলে
দেখবে সকলের মুখে আবার হাসি বেরিয়েছে ।
কথা গুলাে এতাে সত্যি যে আর
মিস্টার জাকিরের মুখ থেকে এর কোন জবাব বেরুলাে না ।
পরের দিন তিনি আবার
পুলিশ স্টেশনে ফোন করলেন । জিজ্ঞেস করলেন কোন । খোঁজ পেলেন আমার মেয়ের ?
- ওপাশ
থেকে জবাব এলাে , না স্যার কোন হদিস পাই নি , খবর পেলেই আপনাকে জানাব ।
মিস্টার জাকির বুঝতে পারলেন যে আর সে মেয়ের খবর পাবেন না । এখন সে
স্বাবালিকা , এখন আর তার মেয়ের উপর কোন অধিকার নেই । এখন সে যাকে খুশি
বিয়ে করতে পারে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে । রেজেস্ট্রি । ম্যারেজ
শুধু তিনজন সাক্ষী হলেই চলে যাবে । হয়তাে তা - ই - ই করে ফেলেছে । সে ,
তার নিজের ইচ্ছে মত কাউকে হয়তাে বিয়ে করেছে ।
দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল
। এবার তাঁকে কোয়ার্টার ছাড়তে হবে । কোয়াটার ছাড়বার নােটিসও এসে গেছে ।
রাজশাহী যাওয়ার সব কিছু তিনি ঠিক করে ফেললেন ।
২
চলে
গেলেন রাজশাহীতে । কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মিসেস জাকির কে নিয়ে , এখানে এসে
তিনি আরাে অসুস্থ হয়ে পরলেন । অসুখ মানুষের হয় ঔষধ খেলে আবার ঠিক হয়ে
যায় ।
থাকতে থাকতে টুকটাক লােক জনের সাথে পরিচিত হয়েছেন মিস্টার । জাকির ,
লােকজন জিজ্ঞেস করলাে , আপনার স্ত্রী নাকি অসুস্থ ?
- জি এখানকার পানি ,
বাতাস সহ্য করতে পারছে নাতাে তাই ।
মিস্টার জাকিরের ওসব রােগ নেই । তাঁর
শুধু সময় কাটানেনা । তাই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে ঘুরতে পারেন না বলে
একটু মন খারাপ লাগে । প্রথম দিকে শুধু জ্বর হয় আবার সেরেও যায় , কিন্তু
মানসিক আঘাত পেলে সামান্য জ্বরও গিয়ে বেশী জ্বরে দাঁড়ায় । রাত্রে ঘুম
আসে না ।
- মিস্টার জাকির তাঁকে সান্তনা দিতে চেষ্টা করেন , বলেন , মনে করে
নাও না যে তােমার মেয়ে কচি মারা গেছে । যে আমাদের উপর এত অকৃজ্ঞ হতে পরে
তার কথা না ভাবাই ভালাে । কিন্তু ভাবা না ভাবা কি মানুষের আয়েত্বের মধ্যে ?
তারপর এই জ্বর একটু কমে আসে তাে আবার বাড়ে । ডাক্তার ডাকা হয় ।
হােমিওপাথি সবই চেষ্টা করে দেখা হয় । যাতে রােগ সারে তাই ভালাে , সেটা ।
এলােপ্যাথি হােক আর কবিরাজই হােক । ঘুম থেকে উঠেই মিস্টার জাকির জিজ্ঞেস
করেন , আজ কেমন আছাে ?
- কাল রাতে এক মিনিটও ঘুম হয় নি । কেবল কচির কথা
মনে পরছে । কোথায় আছে কি খাচ্ছে , কী পরছে সেই কথাই কেবল ভাবছি ।
- ও সব
আর ভেবাে না , সে এখন ম্যাচিউর্ড হয়েছে । তার একটা স্বাধীন ইচ্ছে বলে কথা
আছে । এখন সে যা ইচ্ছে করতে পারে ।
- কচি এমন করবে যদি জানতাম তাহলে তাে
আগেই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিতাম ।
-
সে চেষ্টা তাে আমরা কতবার বলেছি । সেই রিটনের মতো ভালো ছেলেকেও সে কালাে
বলে নিজেই করে দিল । তখনই বুঝা উচিৎ ছিল যে ওর । কপালে অনেক কষ্ট আছে ।
মিসেস জাকির বিছানা থেকে উঠতেন না তখন , কােন মেয়ের কথাই মনে । পরতাে ।
কোথায় না জানি সে কত কষ্টে আছে , সকালবেলা তার এক কাপ দুর্গ খাওয়া ছিল
তার অভ্যেস । গােসল করার আগে দুধের সর আর কমলালেবুর খােসা একসঙ্গে বেটে
সারা শরীরে মাখতাে পাবাের চামড়া ভালাে থাকলে ললে ।। কলেজ থেকে এসে পেস্তা
বাদাম , আঙ্গুর , আপেল ছিল তার দৈনিক জলখাবার । মেয়ের জন্য কত কি করেছে
বাপ মা । সেই সমস্ত কথা ভুলে গিয়ে মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল ।
আগের থানার
পুলিশ একদিন খবর দিল ফোনে , আপনার মেয়ের খবর পাওয়া গেছে ।
চমকে উঠলেন
মিস্টার জাকির । বললেন , কোথায় আছে ?
- আপনার এলাকাতেই , নদীর ধারের এক
বস্তিতে
- সে কি আমার মেয়ে বস্তিতে আছে । আমি চিনব কিভাবে সেখানকার ঠিকানা
?
আগামী কাল আমি আসছি , আপনি কোন টেনশন করবেন না , কাল আপনাকে নিয়ে যাবাে
।
- সঙ্গে কে আছে ?
- একজন মােটর মেকানিক , একটা কারখানার ।
- সে কত টাকা
মাইনে পায় যে আমার মেয়েকে নিয়ে সংসার চালায় ?
- কোন রকমে চালায় ,
মাইনে তাে বেশী পায় না । আর আপনার মেয়ে তাে কোর্টে প্র্যাক্টিস করে ।
-
কোর্টে প্রাক্টিস করে অবাক কাণ্ড !
পরের দিন পুলিশ মিস্টার জাকিরকে নিয়ে
নদীর ধারের বস্তিতে গেলেন । ঠিক বস্তির সামনে একটা ছােট পুরােনাে টিনের
বাড়ি । সেখানেই তাঁর মেয়ে থাকে ভেবে চোখ দিয়ে পানি এসে গেল মিস্টার
জাকিরের । মেয়ে এতাে আদরে মানুষ করেছেন , সেই মেয়ে কি না এই রকম বাড়িতে
থাকে । এটা ভাবতেও তার লজ্জা হচ্ছে ।
দরজার কড়া নাড়াতেই একজন ঝি ভেতর
থেকে দরজা খুলে দিল । পুলিশের গায়ে সাদা সিধে পােষাক পুলিশ বলে চেনা যাচ্ছে
না ।
- জিজ্ঞেস করল , রাসেল কি বাড়িতে
আছে ?
- ঝি ভিতর ভিতর থেকে বলল , উনি তাে বাড়িতে নেই অফিসে গেছেন ।
- কখন
আসবে ?
- বাড়ি আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে ।
- আর তার স্ত্রী ?
উনি কোর্টে
গেছেন ।
- তুমি এ বাড়িতে কাজ কর ?
- হ্যা।
উনি
কখন কোর্টে যান ?
- তা জানি না ।
মিস্টার জাকির এতক্ষণ কিছুই বলছিলেন না ,
তিনি শুধু চারদিকে চেয়ে দেখছিলেন , এই পাড়া এই বস্তি এই কষ্ট .... এ ...
কেমন করে কষ্ট করছে কচি !
এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়ােজন হয় না ।
পুলিশের সঙ্গে মিস্টার জাকির চলে এলেন । জীবনে তিনি অনেক লােককে কষ্ট
দিয়েছেন , অনেক নেতাকে জেলে পুরেছেন । কত মানুষকে কত অত্যাচার করেছেন । কত
লােককে গুলি করে গুম করে দিয়েছেন তার কোন ইয়ত্ব নেই । কত স্ত্রীকে বিধবা
করেছে তখন তার কোন কান্না আসে নি । কিন্তু আজ নিজের মেয়ে এই দূর্দশা দেখে
তাঁর ভীষণ কান্না পাচ্ছে ।
সন্ধ্যা বেলা রাসেল কারখানা থেকে ফিরল ।
সাধারণত সে - ই আগে আসে । সারাদিন কারখানায় কাজের মধ্যে ডুবে থেকে এই
সময়ে বাড়িতে এসে গােসল করে নিয়ে আবার সেজে গুজে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে
ওঠে ।
তারপর বাড়িতে আসে কচি । সারাদিন কোর্টে মক্কেল আর জজদের এজলাসে এ
ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে । তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে
বাসে চড়ে বাড়িতে এসে পৌছায় ।
রাসেল বাড়িতে আসতেই ঝি খবরটা দিল । বলল ,
আজকে দু'জন লােক এসেছিল আপনাকে খুঁজতে।
আমাকে ? রাসেল একটু অবাক হয়ে গেল
। বলল , আমাকে না কচিকে ?
দু’জনের নামই বলল । দু'জনকেই খুঁজছিল , আর
জিজ্ঞেস করেছিল এ বাড়ির ভাড়া কত ।
- তুমি কি বললে ?
চলবে.................
কোন মন্তব্য নেই